১
প্রতিদিনের মত স্বপ্না জানালা টা খুলে দিয়ে সোজা কিছুদূরে অবস্থিত বড় গাছটির দিকে তাকিয়ে আছে। তবে কী যেন অনুপস্থিত আজ সে গাছের নীড়ে। নীরব জায়গা, সরু রাস্তাটির পাশে গিজগিজ করা দালানবাড়ি গুলোর পাশে বড়সড় বৃত্তাকৃতির মাঠ। সেই মাঠের এক কোণে গাছটি। দিনের বেলায় সে মাঠে নানান খেলাধুলায় মেতে উঠে কিশোর-কিশোরী, প্রাপ্ত বয়স্করাও। তবে একটি মাত্র ছেলে সেই মাঠের পাশে গাছটির নিচে এসে কী যেন টাইপ করে মোবাইলে, তাও রাতে যখন জায়গাটি নীরব থাকে। কাঁধেচাপা একটি ব্যাগ থাকে। তবে তার দৈনন্দিন এই মোবাইলে টাইপ চর্চাই কি যেন একটা রয়েছে, হয়ত দুঃখ কিংবা সুখ। স্বপ্না এসব শুধু দূর থেকে দেখে আর ভেবে যায়, নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে...।
সে রাতে একটু দেরি হলেও ছেলেটি গাছটার নিচে আসলো। আজ স্বপ্না ঠিকই করে নিয়েছে ছেলেটার সাথে সে কথা বলবে। তার চাপা কষ্টের মূল কাহিনী টা বেশ জানতে ইচ্ছে করছে।
২
এই যে শুনছেন! ছেলেটি কোন জবাব দেয় নি, মোবাইলে টাইপ করে দেখাল- ‘জ্বী বলুন?’ আমি একটু দ্বিধা বোধ করলাম সুন্দর চেহারাবন্দি দু'টো ঠোঁট, অথচ নির্বাক হয়ে মোবাইলে…! তবু কিছু বলিনি। জিজ্ঞেস করলাম- কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছি আপনি প্রায় এখানে আসেন। কোন সমস্যা? আবার মোবাইলে টাইপ, ‘না, কোন সমস্যা না’। এইবার আর রাগ পুষে রাখতে পারলাম না। আচ্ছা আপনার তো মুখ আছে কথা বলেন। আবার সেই মোবাইলে টাইপ- ‘আমি কথা বলতে পারি না’। এইবার সত্যি আমি অবাক হলাম! তবু অনেক দুঃখ প্রকাশ করে ছেলেটির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করলাম। নিজেকে অনেক দোষী মনে হচ্ছে।
আচ্ছা, আপনার দুঃখ টা তাহলে এখানে। দেখুন পৃথিবীতে আপনি একা শুধু কথা বলতে পারেন না তা নয়। আরো অনেকে আছেন যারা কথা বলতে পারে না। তাই বলে এভাবে রাতবিরেতে নিজেকে কষ্ট দিবেন? টাইপ- ‘আসলে আমি এটাকে কোন দুঃখ বা কষ্ট মনে করি না। নিজের ভেতর চেপে রাখা কষ্ট গুলো আমার এই মোবাইলের ডায়েরীর পাতায় মেলে ধরি, তাতে নিজেকে একটু হালকা মনে হয়।’ ওহ! আপনি ডায়েরী লিখেন, এটা তো ঘরে বসে ও হয়। এখানে এই অবস্থায় কেন? টাইপ- ‘কেন? তা আপনি বুঝবেন না! জানতে চান কেন আমি এখানে এসে নিজের দুঃখ গুলোকে শান্তিতে পরিণত করি?’ আমি এক মুহূর্ত দেরি না করে কৌতুহলে বলে ফেলি- ‘অবশ্যই জানতে চাই।’ টাইপ- ‘এই নিন, রাত্রে আমি যা মোবাইলের ডায়েরীতে টাইপ করি সব এই বাস্তবিক ডায়েরীতে স্পষ্ট ভাবে লিখে রাখি। জীবনের যতসব যন্ত্রণা, এই ডায়েরীতে সব বর্ণিত আছে।’
‘ছেলেটি তার কাঁধেচাপা ব্যাগটি থেকে একটি “নীল ডায়েরী” আমাকে দিলো।’ আপনার নামটাই তো জানা হলো না। যদি বলতেন? টাইপ- ‘কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। আজকের এই আহ্লাদ আগামীকাল ঘৃণ্য হবে আমার জানা আছে। ডায়েরী টা পড়লে আমার নাম সহ সব জানবেন। কালকে এই সময় আমি আবার এখানে আসবো। আপনি চাইলে আসতে পারেন। তবে মনে হয় না ডায়েরী টা পড়ার পর আপনি আর আসতে চাইবেন।’ আমি একটু সংশয়ে পরে গেলাম, জানি না কি আছে এমন এই ডায়েরীতে। তবু আসবো বলে কথা দিয়ে ডায়েরী টা নিয়ে চলে এলাম।
৩
“নীল ডায়েরী” পাতা খুলেই দেখি একটি ছবি। হয়ত ছেলেটির মায়ের! তারপর—
আমি মাসুদ, এই ছবিটি আমার মায়ের। এক দরিদ্র, দুখিনী মা! অনেক দরিদ্র প্রতিকূলতার সাথে তাল মিলিয়ে আমাকে মানুষ করেছেন তিনি। তবে আফসোস আমি তাকে সুখের এতটুকু ছোঁয়া ও দিতে পারিনি। আমি তখন খুব ছোট সবে বুঝতে শিখেছি, উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম তখনি- আমার “কি যেন একটা” নেই। ধীরেধীরে বুঝতে পারলাম আমি একজন বাক-প্রতিবন্ধী। তখন অনেক, অনেক দুঃখ হতো। মা’কে জিজ্ঞেস করতাম হাতের ইশারা দিয়ে- ‘মা’গো আমি কি কোন দিন কথা বলতে পারবো না?’ মা আমার তখন কাঁদত। সান্ত্বনা দিতো, বলতো- ‘না, খোকা তুই কথা বলতে পারবি। বড় হয়ে অনেক টাকা-পয়সা রোজগার কর। তারপর দেখবি…।’
মায়ের এমন প্রতিশ্রুতি আমি সচরাচর পেতাম। প্রায় প্রত্যেকটা দিন মাকে এই একটা প্রশ্নবিদ্ধ করতাম। ইশারা দিয়ে বলতাম- মা আমি “কি যেন একটা” বেশ শূন্য অনুভব করি। আমি কি সত্যি কোনদিন…?! তারপর একটু একটু বেড়ে উঠবার সাথে সাথে খোলাসা হয়ে যায় যে আমার এই শূন্যতা নিয়ে জীবন যাপিত করতে হবে। আমি আর দশ জনের মত নই।
তখন ভাবতেই বেশ দুঃখ হতো যে আমি একজন প্রতিবন্ধী! হোক সে ধ্বনিতে, তবু আমি একজন প্রতিবন্ধী। তবে বয়স যখন আরো একটু বেড়ে গেল তখন সবচেয়ে বড় শূন্যতা আমি অনুভব করি। আর সে অনুভূতি হল আমার বাবা! সব ছেলেমেয়ের মা-বাবা দু’জনেই বেশ প্রাধান্য রাখে জীবনে। কিন্তু আমার বাবা ও যে নেই। মা’কে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস ও করেছিলাম কিন্তু যতবার জিজ্ঞেস করেছি উত্তরে শুধু মায়ের অশ্রু পেয়েছি। তাই এখন আর জানতে চাই না, জানতে চাই না বাবা নামের মহান মানুষটির কথা। মা’কে নিয়েই তো বেশ আছি। মা-বাবা দু’জনের ভালোবাসায় যেন শুধু আমার মায়ের ভিতর টলমল। এভাবে আমার শৈশব-কৈশর কেঁটে যাই। মা’কে ও বুঝতে দেয় না আমার শূন্যতা।
নানান সুখ-দুঃখে আমার মা আমাকে মানুষ করেছেন। প্রাথমিক, উচ্চবিদ্যালয় অতিক্রম করে আমি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। সংসার ও মোটামুটি চলে যাচ্ছে। বেসরকারি একটি অফিসে নাইট শিফট এ কাজ করি। পড়ার খরচ ও যোগাড় করি সেখান থেকেই।
৪
সেদিন ভার্সিটি থেকে এসে দেখি আমার এক দূসম্পর্কের চাচা মা’কে এসে কি যেন বলছে। চাচা টা খুব ভালো, প্রায় আসে, মায়ের সাথে কথা বলে। কিন্তু আজকে অন্যরকম লাগছে দু’জনকেই। মা কাঁদছে! চাচা মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কি যেন বলছে, হয়ত সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আমি ঘরে ঢুকতেই মা চোখের পানি মুছে নিলো। মা’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম কী হয়েছে? কিন্তু মা কিছু বলেনি। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এবার চাচাকে অনেক জোরাজুরি করে জানতে চাইলাম কি হয়েছে। চাচা সহজ ভাষাই বললেন- ‘চল বাইরে চল বলছি!’ আমি কিছুটা ইতস্ততভাবে চাচার পেছন পেছন গেলাম।
দেখ মাসুদ তুই তো জানিস আমি তোর এক দূরসম্পর্কের চাচা। কিন্তু কী রকম চাচা সেটা তো জানিস না। অবশ্য তোর মা আমাকে বারণ করেছিল তোকে এসব কথা বলতে! তবুও বলছি, কারণ তুই একদিন অপ্রস্তুত ভাবে এসব কথা জানতে পারলে নিজের মা’কে ভুল বুঝবি হয়ত। আসলে আমি তোর সে রকম কোন চাচা নই। তোর বাবা ছিলেন আমার বন্ধু, আমারা একই গ্রামের। তোর মা তোর বাবাকে খুব ভালোবাসতেন। কিন্তু তোর বাবা ভালোবাসার নামে প্রতারণা করেছিল তোর মায়ের সাথে।
একদিন তোর মায়ের সরলতার সুযোগ নিয়ে তোর মা’কে বিয়ের আশ্বাস দিয়ে, সে এক ঘৃণ্য আচরণ করেছে তোর মায়ের সাথে। কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর যখন তোর মা তোর বাবাকে বিয়ের প্রস্তাব রাখলো। তখন তোর বাবা মুখ লুকিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সম্ভ্রান্ত পরিবারের ছেলে, তাই এতে কোন বাধাবিপত্তি ঘটলো না। এদিকে তোর মা তখন প্রায় চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা। পরিবারকেও জানাতে পারলো না ভয়ে। শেষে আমার কাছে ছুটে এসেছিল। আমার আজো মনে পরে তোর মায়ের সেদিনের কথা। আমি বলেছিলাম- ‘অন্য লোকের বোঝা তুমি বয়ে চলবে কেন? ফুল টা ফুঁটে পাপড়ি বেরিয়ে যাওয়ার আগেই মুকুল টা ঝেড়ে ফেলে দেন!’ কিন্তু তোর মা বলেছিলো- ‘না ভাই জান, আমাদের পাপের ভাগ এই নিষ্পাপ পুষ্প-মুকুলটি কেন নিবে! আমি এই কিছুতে করতে পারবো না। এ তো শুধু ঐ প্রতারকের মুকুল নই, এ আমারো একটা আশার প্রদীপ! আমাকে মাতৃ পরিচয় দিয়ে গর্বিত করবে এই প্রদীপ।’………
তারপর—
তোর মা সেদিন চাপা কন্ঠে খুব কেঁদেছিল। স্বজনদের ছেড়ে সে এক কাপড়ে বেরিয়ে যাই বহুদূর, যা শুধু আমি জানতাম। সব কষ্টের প্রতিকূলতার সাথে যুদ্ধ করে তোর মা তার প্রদীপ টা হাতে পেলেন। সেই প্রদীপ আর কেও নয়, তুই নিজে মাসুদ! অনেক কষ্ট করে তোকে মানুষ করেছে তোর মা, হ্যা হয়ত কিছু অভাবে ছিলি। কিন্তু মা-বাবার অভাব সে তোকে বুঝতে দেয় নি। পরিপূর্ণ করেছে তোকে স্নেহ মমতায়। আর কেও না জানুক, আমি জানি। এমন মা’কে কখনো কষ্ট দিস না মাসুদ। এমন মা পৃথিবীর বুকে খুব কমই পাবি।
৫
আমি খেয়াল করলাম ডায়েরী এখনো পূর্ণ হয় নি। তবে আরো কিছু লিখবে মাসুদ, তা বেশ ভালো বুঝতে পারছি। বেশ কিছু পাতা এখনো খালি আছে। তবে আমি ভাবছি এমন মা-ছেলে ঘৃণ্যতার যোগ্য কখনো হতে পারে না। এরকম মা’কে তো অজস্র সালাম দিলেও পূর্ণত্ব হবে না।
সেই রাত আর ঘুমাই নি আমি। পরেরদিন কাঁটালাম অনেক কষ্টে। সন্ধ্যার আগেই আমি সেই গাছটির নিচে পৌঁছে অপেক্ষায় আছি মাসুদ কবে আসবে।
মাসুদ এসে পৌঁছালো। মাসুদ কোন কথা বলার আগেই আমি মাসুদকে জড়িয়ে ধরে মৃদু কেঁদে দিলাম। তারপর একটু স্বস্তি ফিরিয়ে মাসুদকে জিজ্ঞেস করলাম- ‘তারপর কী হয়েছিল মাসুদ।’ টাইপ- ‘তারপর, আমি সেদিন মা’কে জড়িয়ে ধরে ঠিক এভাবে কেঁদেছি। যেভাবে তুমি আজ আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে। কিন্তু আজো আমার শূন্যতা রয়ে গেল! সেদিন হয়ত কিছু শুন্যতার খোঁজ আমি পেয়েছি। কিন্তু আজকের শূন্যতা কখনো পরিপূর্ণ হবার নই। আমার জীবনে “কি যেন একটা” শূন্যতা ধাধার মত রয়েই গেল। কিছু মাস আগে আমার মা ও আমাকে ছেড়ে চলে যায়! জানি সেই মায়ের শূন্যতা কেও আর পূরণ করতে পারবে না। আজ আমার অনেক কিছু নেই। কিন্তু এর মাঝে শুধু “কি যেন একটা” নেই মনে হয়।’
আমি মাসুদকে আর কিছু বলতে পারি নি। তবে মাসুদের মায়ের জন্য বুক ফুলিয়ে বলতে ইচ্ছে করে- সার্থক তুমি নারি জাতি, সার্থক তোমার মাতৃত্ব।
১৩ ফেব্রুয়ারী - ২০১৬
গল্প/কবিতা:
৩৮ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪